রবি মিয়া ধর্মপাশা( সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় শনিবার সকাল ১১টায় বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির ধর্মপাশা উপজেলা কমিটির সভাপতি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সহ-সভাপতি প্রখ্যাত কৃষক জননেতা মতিয়র রহমানের শোকসভা অদ্য ৯ সেপ্টেম্বর বাদশাগঞ্জ বাজারে অনুষ্ঠিত হয়। কৃষক সংগ্রাম সমিতির সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খায়রুল বসর ঠাকুর খান এর সভাপতিত্বে শোকসভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কেন্দ্রিয় সহ-সভাপতি শ্যামল কুমার ভৌমিক। শোকসভার শুরুতে প্রয়াত মতিয়র রহমান ও কৃষক সংগ্রাম সমিতির উপজেলা কমিটির অন্যতম সদস্য অনিল কুমার স্মরণে ১ মিনিট শোক নিরবতা পালন করা হয়।
শোকসভায় অন্যান্যদের মধ্যে আলোচনা করেন বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রিয় সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান কবির, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কেন্দ্রিয় যুগ্ম আহবায়ক রহিমা জামাল, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রিয় যুগ্ম সম্পাদক প্রকাশ দত্ত ও তফাজ্জল হোসেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সুনামগঞ্জ জেলার সভাপতি রত্নাংকুর দাস জহর ও নেত্রকোনা জেলার আহবায়ক মাস্টার মতিউর রহমান, কৃষক সংগ্রাম সমিতির সুনামগঞ্জ জেলার সভাপতি এডভোকেট নিরঞ্জন তালুকদার, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির ময়মনসিংহ জেলার আহবায়ক বাবলী আকন্দ, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের ধর্মপাশা উপজেলা কমিটির সভাপতি নূর উদ্দিন আহমেদ, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির উপজেলা কমিটির আহবায়ক জ্যোৎস্না বেগম, সদস্য জেরিন আক্তার ও জাতীয় ছাত্রদলের নেতা আল তাসলিন কান্তা ও আদনান সামি প্রত্যয়। শোকসভা সঞ্চালনা করেন কৃষক সংগ্রাম সমিতির উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আলম।
আলোচকগণ তাঁদের বক্তব্যে বলেন, মতিয়র রহমানের শোকসভা শুধু শোক প্রকাশের জন্য নয়। শোককে সংগ্রামে পরিণত করার জন্য এই শোকসভার গুরুত্ব অপরিসীম। মতিয়র রহমানের রাজনৈতিক জীবনের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে আলোচকগণ বলেন, প্রয়াত মতিয়র রহমান ১৯৪৪ সালের ১ মে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নেত্রকোণা সরকারী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ার সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে শিক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হোন। পরবর্তীতে স্নাতক (পাস) সমাপ্ত না করেই তিনি কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাথে যুক্ত হোন। শ্রমিক কৃষক জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি (এম-এল) এর সাথে যুক্ত হোন। আলোচকগণ বলেন, তৎকালীণ সময়ে শ্রমিক শ্রেণীর মহান রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক জোসেফ স্তালিনের মৃত্যুর পর সংশোধন বাদীরা পার্টির নেতৃত্বে এসে সংশোধনবাদী তিন শান্তি নীতির তত্ত্ব গ্রহণ করে। এ পেক্ষিতে সংশোধন বাদীদের দ্বারা কমিউিনিষ্ট আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হলে মার্কসবাদী-লেনিনবাদকে প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী আপোসহীন কমিউনিষ্ট বিপ্লবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদী তত্ত্বের আলোকে কমিউনিষ্ট আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠায় কমরেড আবদুল হক, হেমন্ত সরকার, অজয় ভট্টচার্য ও দীনেশ চন্দ্র চৌধুরীদের নেতৃত্বে দেশব্যাপী কমিউনিষ্ট তৎপরতা অগ্রসর হলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মতিয়র রহমান তিন শান্তি নীতির তত্ত্ব তথা ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাশাপাশি উগ্র-জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার সাথে সাথে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও চীনের কমিউনিষ্ট পার্টি সংশোধনবাদী তিনবিশ্ব তত্ত্ব সামনে আনলে এর বিরুদ্ধে তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকা উর্দ্ধে তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তিনি কিছুদিনের জন্য জয়শ্রী জুনিয়র হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ৮০’র দশকে বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় তিনি আবার কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তিনি তার অকৃত্রিম সহযোদ্ধা ও বন্ধু প্রয়াত সামসুল আলম মাস্টার, আব্দুল ওয়াহাব তালুৃকদারসহ অন্যান্য সহযোদ্ধাদের নিয়ে মাটিকাটা কামলাদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ৮০’র দশকে সুনামগঞ্জ জেলায় ভাসান পানির আন্দোলন শুরু হলে মতিয়র রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ৮৮ সালে সংঘঠিত হওয়া মারাম বাধ আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। উপজেলার গাবী গ্রামের ভূমিহীন কৃষক লালচান হত্যার প্রেক্ষিতে ১৯৮৯ সালে তিনি ঐতিহাসিক ভূমিহীন আন্দোলন গড়ে তোলায় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠা হলে তিনি ধর্মপাশা উপজেলায় ফ্রন্ট গড়ে তোলার কাজে উদ্যোগী ভূমিকা ও নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে পুনরায় শুরু হওয়া সুনামগঞ্জ জেলায় চলমান ভাসান পানির আন্দোলনে মতিয়র রহমানের রয়েছে উদ্যোগী ও সাহসী নেতৃত্বের ভূমিকা। মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি কৃষক জনগণের মুক্তির আন্দোলনে নিরলস ভূমিকা রেখে যান। আজীবন বিপ্লবী এ নেতা জনগণের মুক্তির আন্দোলন অগ্রসর করতে অকৃতদার থেকে যান।