রিপন কান্তি গুণ, নেত্রকোনা প্রতিনিধি:
চৈত্র মাসের শেষ দিন আজ। এই দিনটিকে বাঙালি ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ হিসেবে উদযাপন করে। আবহমান বাংলার চিরায়ত বিভিন্ন ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্র সংক্রান্তি। আগামীকাল রবিবার পহেলা বৈশাখ, নতুন বাংলা নববর্ষ-১৪৩১।
চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে আজ (১৩ এপ্রিল) শনিবার প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা বাঙালির ঐতিহ্য চড়ক পুজা নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা সদরের গড়মা গ্রামে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পূজার প্রচীন ইতিহাস থেকে জানাযায়, প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা, চড়ক পূজার অপর নাম নীল পূজা, মহাদেব পূজা, গম্ভীরা পূজা বা শিবের গাজন পূজা। শিব-পুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্রে শিব আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি ও ধর্মীয় নাটক উৎসবের উল্লেখ রয়েছে।
পূজার ঐতিহ্য হিসাবে, বেল কাস্ট নির্মিত মহাদেবকে চৈত্রমাসের ১৫ দিন, ১১ দিন, ৭দিন, ৩ দিনের দিন স্নান করিয়ে সিঁদুর ও সরিষার তেল মাখানো হয়। তারপর লালচি দিয়ে ভালভাবে জড়ানো হয়। পরানো হয় আকন্দ, জবা,বেলী, গন্ধাঁ ফুলের মালা সহ বেল পাতার তৈরি মালা। লাগানো হয় স্বর্ণের চোখ।তারপর বাড়ী বাড়ী ঘুরে সংগ্রহ করা হয় চাল, তরকারী,ফল, বাতসা আর টাকা। চড়ক গাছের ক্ষেত্রে আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে ‘শিবঘট বা বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাতরা (পাঠা বলির জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) আর বড় ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, খেঁজুর ভাঙ্গা, চড়কগাছে দোলা এবং হাজরা পূজা করা।
এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। । পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুক দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেওয়া হয়।
সর্ব স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন। তবে নিম্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়। এ পূজায় কোন ব্রাহ্মনের প্রয়োজন পড়ে না।পূজার উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল চড়ক পূজার শুরুতে শিবপাঁচালী পাঠক মন্ত্রপড়া শুরু করলে সন্ন্যাসীরা শিবধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান। স্নান শেষ করে মাটির কলসি ভরে জল আনেন তারা। এরপর চড়ক গাছের গোড়ায় গোল হয়ে দাঁড়ান সন্ন্যাসীরা। আবার শিবপাঁচালী পাঠ করতে থাকেন বালা বা শিবপাঁচালী পাঠক।
সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রণাম করে চলে যান ফাঁকা জায়গায়। সেখানেই তাদের বাণবিদ্ধ করা হয়। সন্ন্যাসীরা নিজের শরীর বড়শিতে বিঁধে চড়কগাছে ঝুলে শূণ্যে ঘুরতে থাকেন। আবার সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদও করেন।।এ অবস্থায় একহাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘুরাতে থাকেন আর অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছড়ান। এই ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা তাদের বিশ্বাস জগতে যারা শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছেন বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার পথ সুগম করে দেবেন।
চৈত্র সংক্রন্তির ১৫ অথবা ৭ দিন আগ থেকে শুরু হয় চড়কের প্রস্ততি। উৎসবের আমেজ শুরু হয় গ্রামের বারোয়ারি তলায়, শ্মশানে কিংবা গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায়। যেখানে আর যেভাবেই এই উৎসব উপস্থাপিত হোক না কেন এর মূল লক্ষ্য থাকে দেবতা শিবের আবাহন। শিবই এই উৎসবের মুখ্য। তাই শিবকে সন্তুষ্ট করাই পূজারীদের উদ্দেশ্য। শিব দেবতা বা মহেশ্বরের পূজা মানেই নীল পূজা আর এই পূজায় বয়ে আনবে চরম মোক্ষ লাভ।
চড়ক পূজা দেখতে আসা কয়েক’জন দর্শনার্থীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বলেন, চড়ক পূজা দেখতে এসে তান্ত্রিকদের বিভিন্ন খেলা দেখে আমরা খুবই আনন্দ উপভোগ করেছি আবার কিছু কিছু খেলায় ভয়ও লেগেছে। সবকিছু মিলে আনন্দ নিয়েই বাড়ি ফিরছি।
চড়ক পুজার ঐতিহ্য হিসাবে পুজাতে নানা ধরনের অলৌকিক খেলা দেখানো হয়ে থাকে। পুজা এবং এসব খেলা দেখতে অনেক দুরদুরান্ত থেকে মানুষ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পুজা ও এসব খেলা দেখতে আসেন।